একজন জিজ্ঞাসা করলেন—ইষ্টে বিশ্বাস আসে কি ক’রে?
শ্রীশ্রীঠাকুর—বিশ্বাস আসে ভক্তি থাকলে। বিশ্বাস জিনিষটা মূলতঃ ভক্তি। কারও উপর হাড়ভাঙ্গা টান হ’লে, তার সম্বন্ধে আর প্রশ্ন থাকে না। এই প্রশ্নহীন ভাবটাই বিশ্বাস। আমার নিজ অস্তিত্ব-সম্বন্ধে যেমন আমার কোন প্রশ্ন নেই। আমি আছি এটা আমার কাছে অবধারিত। আমার জীবনে আমার ইষ্টই সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান এমনতর অকাট্য ভালবাসা যখন গজায়, তখন সে-বোধ আর টলে না। তিনি অত্যাচার করলেও মনে কোন বিরূপ ভাব আসে না। সবতাতেই আমি রাজী। সুখে থাকলেও তাঁকে নিয়ে বিভোর হয়ে থাকি। দুঃখে থাকলেও তাঁকে নিয়ে বিভোর হয়ে থাকি। এই নেশা কিছুতেই কাটে না। একেই বলে বিশ্বাস বা নিষ্ঠা। বেকায়দায় প’ড়লে যখনই ভক্তি চ’টে যায়, দোষারোপ বা অনুযোগ- অভিযোগের বুদ্ধি আসে, তখনই বুঝতে হবে ভক্তি-বিশ্বাসের পাড়ায় আমরা ঢুকিনি। স্বার্থলোভে যারা ভগবানকে ভজে, তাদের ভক্তি স্বার্থে, ভগবানে নয়। ভগবানকে দিয়ে তারা নিজেদের সুখ-সুবিধা আদায় ক’রে নিতে চায়। ভগবানকে বাদ দিয়ে অন্য কোনভাবে সুখ-সুবিধা হাসিল হ’লে তাই নিয়ে মজে থাকতেও তাদের আপত্তি থাকে না। তবে অনেকে ভয়ে ভগবানকে মানে ও ডাকে। ভাবে, তাঁকে না মানলে পাছে যদি কোন বিপদ- আপদ হয়। ভক্তি-বিশ্বাসের নামে নানারকম মিথ্যাচার ও ভণ্ডামি নিয়ে চলে অনেকে। অনেকের আছে না ক’রে ভাল ফল পাওয়ার বুদ্ধি এবং অপকর্ম্ম যা’ করেছে তার ফল এড়াবার অভিসন্ধি। এই মতলবে ভগবানের দোহাই দিয়ে চলে। কিন্তু তিনি তেমন বান্দা নন যে স্তুতিবাক্যে ভুলে গিয়ে বিধি উল্টে দেবেন। তাই তাদের কল্পনা ও কামনা যখন ফলে না, তখন ভগবানের বিচারে ব’সে যায়। এই ধরণের mentality (মানসিকতা) যেখানে, সেখানে ভক্তি-বিশ্বাসের জায়গা অতি সঙ্কীর্ণ। ধর্ম্মের নামে, ভক্তি-বিশ্বাসের নামে এইসব ফাঁকিবাজী চলে ব’লে বহু লোক ধর্ম্মের মর্ম্ম বুঝতে পারে না। প্রকৃত ধৰ্ম্মবিরোধী এরাই। ভক্তি-বিশ্বাসের সেরা দৃষ্টান্ত হ’লো হনুমান। একটা গোটা জীবন সে রামচন্দ্রকে সুখী করার ধান্ধায়ই কাটিয়ে দিল। আর কোন ধান্ধা নেই। বুক চিরে দেখিয়ে দিল সেখানে রামচন্দ্রই বিরাজ করছেন। তার ঐ কজে জুড়ে একজনই আছেন। তিনি রামচন্দ্র। আর, রামচন্দ্র আছেন ব’লে রামচন্দ্রের যা কিছু মায় বিশ্বদুনিয়াও তার কাছে কত মূল্যবান। কিন্তু রামবিহীন অমূল্য রত্নহারও তার কাছে অসার ও মূল্যহীন। তা সে পোছেই না। কানাকড়িও দাম দেয় না তার। ভক্তি-বিশ্বাস এমনি ক’রেই মানুষকে একাধারে মহা আসক্ত ও মহা নির্লিপ্ত ক’রে তোলে। সে দুনিয়াদারীর পিছনে ছোটে না। কিন্তু দুনিয়ার ঐশ্বর্য্য- মান-যশ তার পিছনে ছোটে। তা’ দিয়ে ইষ্টসেবার সুবিধা না হলে সে সেদিকে ভ্রুক্ষেপও করে না। বরং সন্তর্পণে এড়িয়ে চলে। কোন দুঃখকেই সে দুঃখ বলে মনে করে না, যদি তার ইষ্টভজন অর্থাৎ ইষ্টের সঙ্গ, সেবা, স্মরণ-মনন, যাজন, প্রয়োজন-পূরণ ইত্যাদি অটুট থাকে, অস্খলিত থাকে। আবার, কোন সুখকেই সে সুখ বলে মনে করে না, যদি সে-সুখ ভোগ করতে গিয়ে তিলেকের জন্যও তার মন ইষ্টানুসরণ থেকে বিচ্ছিন্ন বা বিচ্যুত হয়ে পড়ে। তাকেই সে জীবনের পরম দুর্ভাগ্য ও দুর্ঘটনা মনে করে। সে-কষ্ট সে সইতে পারে না। তাহ’লে বোঝেন তার চরিত্রটা কি রূপ নেয়। আবার, ইষ্টকে যে ভালবাসে পরিবেশকেও সে ভাল না বেসে, সেবা না ক’রে পারে না। একজন নিষ্ঠাবান বিশ্বাসী ভক্ত যে-মুল্লুকে থাকে, সে-মুল্লুকের চেহারাই পাল্টে যায়। ও যে কী জিনিষ ক’য়ে বোঝাবার নয়। ঐ রকম মানুষ চৰ্ম্মচক্ষুতে দেখতে পাওয়াও ভাগ্যের কথা।
অন্য একজন বললেন—প্রকৃত নিষ্ঠাবান বিশ্বাসী ভক্ত দুর্লভ, তা বুঝলাম । কিন্তু মানুষ পাপ, অন্যায় ও দোষ ক’রে দুর্ভোগের মধ্যে প’ড়ে আর্ত্ত হয়ে পরমপিতাকে যদি বিপদ- মুক্তির জন্য কাতর কণ্ঠে ডাকে, তাতে কী কোন ফলই ফলে না? দুৰ্বল মানুষের তাহ’লে আশ্রয় কোথায়?
শ্রীশ্রীঠাকুর—প্রকৃত আৰ্ত্ত হ’লে তো হয়ই। আর্দ্র হওয়া মানে সত্তাকে বাঁচাবার ক্ষুধা জাগা। এ-ক্ষুধা জাগলে তখনকার মত মানুষ অনেকখানি obsession (অভিভূতি) থেকে মুক্ত হয়। তার ফাঁকিবাজী, হামবড়াই, আত্মসমর্থনের বুদ্ধি নিস্তেজ হয়। আত্মবিশ্লেষণের ভাব আসে, অনুতাপ আসে, নিজের দোষ-স্খালনের আগ্রহ জাগে, সৎ-সম্বেগ প্রবল হয়। ঐ তো শুভ মুহূৰ্ত্ত জীবনে। তখন বিচার-বিবেচনা ও সিদ্ধান্ত নির্ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বেশী। সাময়িক চলেও ঠিকমত। এই রকমটাই তো পরমপিতার দয়া। এর ফলে অনেকখানি উদ্ধার পেয়ে যায়। রামচন্দ্রের প্রতি আকুল আগ্রহে অহল্যার পাষণ উদ্ধার হয়েছিল অমনি ক’রেই। কিন্তু মানুষ সুদিন পেয়ে আবার যদি ভগবানকে ভুলে যায়, তাহ’লে যা’ হবার তা হয়ই। কৰ্ম্মফল এড়ান যায় না। তবে যারা সদ্গুরুকে গ্রহণ ক’রে নিষ্ঠানিপুণ অনুরাগ নিয়ে কাঁটায় কাঁটায় তাঁর নির্দেশ মেনে চলে, তাদের প্রবৃত্তি, চাল-চলন, চিন্তা ও বুদ্ধি নিয়ন্ত্রিত হবার তালে থাকে। ঐ ধাঁজ যখন এসে যায় জীবনে তখন নতুন ক’রে দুষ্কর্ম্মের সৃষ্টি হয় কম। আর, আগের দুষ্কর্ম্ম-জনিত দুর্ভোগ যদি এসেও পড়ে, তাকেও শুভে বিন্যস্ত করার
ইচ্ছা, বুদ্ধি ও শক্তি জাগে অন্তরে। প্রবৃত্তিগুলির চাইতে ইষ্ট যদি প্রিয় না হ’য়ে ওঠেন, প্রধান না হ’য়ে ওঠেন মানুষের কাছে, তাহ’লে কিন্তু কিছুই হয় না। ইষ্ট আমাদের কল্যাণকর নির্দেশ দিতে পারেন, কিন্তু প্রবৃত্তির বিরুদ্ধ-সম্বেগকে উপেক্ষা ক’রে ইষ্টনিৰ্দ্দেশকে প্রাধান্য দিয়ে চলা আমাদের ইচ্ছাসাপেক্ষ ব্যাপার, অনুরাগসাপেক্ষ ব্যাপার। তার উপর তাঁর কোন হাত নেই। তাই ভগবান আমাদের বাঁচাতে পারেন না। বাঁচাতে পারে ভগবদনুরাগ। এইজন্য গীতায় আছে, মানুষ নিজেই নিজের শত্রু, নিজেই নিজের বন্ধু। নিজের চেষ্টায় নিজেকে উদ্ধার করতে হয়।
প্রশ্ন—তা’ যদি হয়, তাহ’লে গুরুর প্রয়োজন কি?
শ্রীশ্রীঠাকুর (সহাস্যে)—ওরে পাগল! গুরু না হ’লে তোর টানটা ফেলবি কার উপর? টান তো বিলিয়ে দিয়েছিস প্রবৃত্তির উপর। সব দিয়ে-থুয়ে দেউলে সেজে ব’সে আছিস। বাঁচাবাড়ার সম্বল বেহাতি হ’য়ে আছে। এখন তাকে হাতাবি কী ক’রে? ঐ জন্যই গুরু লাগে, যিনি কিনা প্রবৃত্তির অধীশ্বর হ’য়ে সত্তা-সম্বৰ্দ্ধনায় স্বাধিষ্ঠিত আছেন ৷ তাঁকে ভালবাসা ও পূরণ করা লাগে ভালমন্দ সব প্রবৃত্তি দিয়ে। তখনই ওগুলি কাবেজে এসে যায়। মূৰ্ত্ত সত্তাসম্বৰ্দ্ধনাকে লক্ষ্য ক’রে আবর্তিত হ’তে-হ’তে ওগুলিও সত্তাসম্বৰ্দ্ধনী হ’য়ে পেখম তুলে দাঁড়ায় ৷ নানা প্রবৃত্তির নানামুখী দ্বন্দ্ব লোপ পেয়ে গিয়ে জীবনে আসে অপার শান্তি । প্রবৃত্তির জ্বলুনি, পুড়ুনি, রাহাজানি ও দাগাবাজীর হাত থেকে যে মুক্তি পায়, সে যে কত আরাম পায়, তার কী লেখাজোখা আছে? তবে খুব সাবধানে থাকতে হয়। ইষ্টনিষ্ঠাকে অক্ষুণ্ণ রাখতে হয়। ওটা ক্ষুণ্ণ হ’লে প্রবৃত্তিগুলি আবার দৌরাত্ম্য শুরু ক’রে দেয়।
-শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র
আলোচনা প্রসঙ্গে, ৯/১২.৯.১৯৪৭